রৌদ্রডোবা চাঁদ - আবু জাফর খান
নিউজ ডেস্ক:
আপলোড সময় :
১৭-০৮-২০২৫ ১২:৩১:৪৩ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
১৭-০৮-২০২৫ ১২:৩১:৪৩ পূর্বাহ্ন
সাহিত্য- রৌদ্রডোবা চাঁদ - লেখক আবু জাফর খান
সুবর্ণ আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভৈরব বাজার স্টেশন ছেড়ে একটু আগে বেরিয়েছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে মিষ্টি বিকেলটির দিকে তাকিয়ে আছে বিদিতা। দূরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে কয়েকটি মেয়ে হেঁটে আসছে। পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় রাঙানো তাদের মুখ। খানিক বাদেই আলোটি মুছে গেল জানালা থেকে। একটি শ্বাস ফেলে ভেতরের দিকে তাকালো বিদিতা। ট্রেনটি ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পেরিয়ে গেল। বিদিতার পাশের দুটি সিট এখনও খালি।
আখাউড়ায় ট্রেন দাঁড়ালো বেশ কিছুক্ষণ। তখনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে ট্রেনে উঠলেন এক সুদর্শন ভদ্রলোক, সঙ্গে এক প্রৌঢ়া। ডেনিম জিনস আর খয়েরি শার্টের মানুষটিকে দেখে উঠলো বিদিতা। 'কী আশ্চর্য, রন্দ্র না।' চমকে রুদ্র হাঁ করে বিদিতার কিছুক্ষণ দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, 'হোয়াট আ সারপ্রাইজ, বিদি, তুই!' বিদিতার মুখে আনন্দ-সুখের স্মিত হাসি। টিকেট চেকার ভদ্রলোক রুদ্র এবং প্রৌঢ়াকে বসালেন বিদিতার ঠিক পাশের সিটে। রন্দ্র বললো, 'বিদি, আমি কিন্তু এখনও ধন্দে আছি। এটি তুই-ই তো, নাকি তোর ভূতা কতোদিন পর দেখা হলো, কল!' বিদিতা কিঞ্চিত থমকালো। একটু ভেবে বললো, 'তা বছর বারো তো হবেই।'
রুদ্র এখনও বুঝি চমকটির সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারেনি। অবাক চোখে বিদিতাকে দেখছে। এই বারো বছরে একটু ভারী হয়েছে একদা ছিপছিপে রুদ্র পলাশ। চুল কিছুটা পাতলা। গমের রঙের মতো গায়ের রং খানিকটা তামাটে হয়েছে। রুদ্র বসে আছে বিদিতার পাশে। বিমনা, নিশ্চুপ। তার গায়ের সেই ভীষণ চেনা মিষ্টি গন্ধটি বিদিতার নাকে আসছে থেকে থেকে। একযুগ দূর থেকে ভেসে আসছে স্মৃতির সুঘ্রাণ। রুদ্র হেসে বললো, 'কীরে বিদি, তুই তো দেখছি একেবারে আগের মতোই আছিস। সেই পেঁকাটি টাইপ। শুধু চোখে চশমা যোগ হয়েছে। মাঝের বারোটি বছর তোর ওপর কি কোনো ছাপই ফেলতে পারেনি?' বিদিতা হো হো করে হেসে উঠে বললো, 'এই বারো বছর আমার কাছে মনে হয় বারোটি ঘণ্টা মাত্র। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে সকালে জেগে উঠেছি। বয়সের সাথে কেবল বারো ঘণ্টা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আসলে কি তাই!'
বিদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রন্দ্র ভ্রুকুটি করে বললো, 'তোর ছেলেমানুষি স্বভাবটি দেখি এখনও সেই একই রকম আছে। বেড়ে তো উঠেছিস, বড় হয়েছিস কি?' বিদিতার হৃদস্পন্দন সহসা দ্রুত হলো। বহুকাল পর খুলে গেল অতীতের অর্গল। রুদ্রর স্মৃতির বঝাঁপিতে কি কি আজও আজ তবে রয়ে গেছে নীলগিরির ঘটনাটি? বারো বছর পেরিয়ে এসেও সেই রাতটিকে কি ভুলতে পারেনি রুদ্র? সে নিজেও কি পেরেছে? তা কি সম্ভব?
রুদ্র তখন মার্কেটিং নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বিদিতার সাবজেক্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ফ্যাকাল্টিতে। রদ্র থাকতো ফজলুল হক হলে আর বিদিতা জনা দশেক মেয়ের সাথে কলাবাগানের এক মেসে। দুজনার মধ্যে ছিল গাঢ় বন্ধুত্ব। ছটফটে স্বভাবের সুদর্শন রুদ্রর প্রতি বিদিতার অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। রন্দ্রও যে তাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে, সেটিও বিদিতার অজানা ছিল না। কেউ কাউকে প্রপোজ করেনি কখনো, তবুও দুজনের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্ক দানা বাঁধছিল একটু একটু করে। ব্যবসায় প্রশাসনের জনা দশেক ছেলেমেয়ের একটি দুর্দমনীয় গ্রুপের মধ্যমণি ছিল রদ্র আর বিদিতা।
সেদিনের আভায় দুজনের তুমুল বাকবিতন্ডা। গ্রীষ্মের ছুটিতে বিদিতা বাবা-মার সঙ্গে ঘুরে এসেছে রাঙামাটি থেকে। আভড্ডায় উচ্ছ্বসিত বিদিতা গল্প করছিল রাঙামাটি লেকের জলে বোটে বসে সানরাইজ দেখার অপূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে। ওদিকে রদ্ররা কজন মিলে গিয়েছিল বান্দরবানের নীলগিরিতে। সেখানকার মাতাল হাওয়ার স্পর্শ আর সবুজ পাহাড়ের আড়াল ফুঁড়ে সূর্য ওঠার মোহময় দৃশ্যের নাকি কোনো তুলনাই চলে না। সুতরাং রন্দ্র গলা ফাটাচ্ছে নীলগিরির নয়নাভিরাম সানরাইজ নিয়ে। দুজনের বাগযুদ্ধ তুঙ্গে, কেউই হার মানতে রাজি নয়। রন্দ্র চেচিয়ে বললো, 'সি ইট টু বিলিভ ইট। যাবি আমার সঙ্গে নীলগিরিতে? যদি সাহস থাকে, তবে চল। নিজের চোখে দেখে মিলিয়ে নিবি কোনটি ঠিক।' বিদিতার মাথায় তখন জিদের আগুন। সাত-পাঁচ না ভেবেই সোজা হ্যাঁ বলে দিল।
পরদিন সকালে ছোট্ট একটি ব্যাগে কিছু জামাকাপড় ভরে সোজা ছুটলো বাস টার্মিনালে। রন্দ্র বাসস্ট্যান্ডেই ছিল। একই বাসের আলাদা আলাদা সিটে বসে পৌছলো চিটাগাং। সেখান থেকে বান্দরবান হয়ে নীলগিরি। এবার পাশাপাশি বসে। নীলগিরিতে যখন নামলো, তখন বিকেল। চারপাশের সবুজ পাহাড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত রহস্য যেন বিছিয়ে আছে মিহি হয়ে। রন্দ্র বললো, এটিই নীলগিরি। কী, জায়গা কী, জায়গাটি দারুণ না।'
নীলগিরিতে একটিই মাত্র রিসোর্ট। সিঙ্গল বেডেড রুম পাওয়া গেল না। একটি ডাবল বেডেড রুম ফাঁকা ছিল, বাধ্য হয়ে সেটিই নিতে হলো। রুমটি বেশ বড়। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। গরম জলের ব্যবস্থা আছে। অ্যাটাচড বাথ। পুবদিকে ভারি পর্দার ওপাশে বিরাট উইন্ডোগাস। কাচের ওদিকে পাহাড়ের সারি। নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ম্রো আদিবাসী জনপদ। সন্ধেবেলা দুজন এদিক-ওদিক হাঁটলো উদ্দেশ্যহীন। সাতটা বাজতে না বাজতেই নীলগিরি জনবিরল। দুজন রমে ফিরে এলো। রাতে ডিনার দিয়ে গেল রুমে। রুদ্র রেলিশ করে মুরগির ঠ্যাং চিবোচ্ছে। বিদিতার তখন খাবার মতো অবস্থা নেই। মনের মধ্যে তোলপাড়। তুমুল খুঁটে কোনোমতে ভাতগুলো গিললো। ঝোঁকের মাথায় চলে এসে এখন কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়। যে ভয়টি বিদিতা করছিল, ঠিক সেটিই হলো।
রুমে তখন মৃদু নীল রাতবাতি জুলছে। বিদিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে রাতক্রিম মাখছিল। রুদ্র ডিনার সেরে লবি থেকে সিগারেট টেনে রুমে ঢুকলো। সে ধীরে ধীরে হেঁটে এসে বিদিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো। যেন এটি তার অধিকার। বিদিতা ভয়ে জড়সড়। অ্যাডভেধার তখন শিকেয় উঠেছে। বুকের ভেতর চিপচিপ শব্দ। যতটা সম্ভব গলায় বীতরাণ মিশিয়ে সে বললো, 'আই ডোন্ট এক্সপেক্ট ইউ টু ডু দিস, রুদ্র। তোর ওপর নির্ভর করার মূল্য এভাবে নিবি তুই? কস্মিনকালেও ভাবিনি তুই এরূপ আচরণ করবি। ছিঃ।'
বেচারা রুদ্র। আর কেউ হলে কী হতো বলা কঠিন। তবে রুদ্র অন্যদের থেকে আলাদা। ছিটকে সরে গিয়েছিল সে। অপমানে পাংশু হয়ে যাওয়া রন্দ্রর মুখ চোখ বুজলেই এখনও স্পষ্ট দেখতে পায় বিদিতা। অস্বস্তিতে সারা রাত এপাশ-ওপাশ করলো বিদিতা। জানালার পাশের সোফায় বসে একের পর এক সিগারেট টেনে সমন্না রাত পার করলো রণন্দ্র। ভোরবেলা পাহাড় ফুঁড়ে লাল চাকতির মতো নরম সূর্য লাফিয়ে উঠলো আকাশে। পুরো পাহাড়টিকে আলোর প্রপাতে স্নান করিয়ে দিল যেন। অলৌকিক লালচে আলোর রেণু ভিজিয়ে দিল রুমটিকে। বিমনস্ক রুদ্রর নির্বাক দৃষ্টি পাহাড়ের দিকে। দুজনের কারও মুখেই কোনো কথা নেই। সকাল হতেই ঢাকা অভিমুখে যাত্রা এবং অতঃপর আবার নিজভূমে।
সে রাতের কথা বিদিতা কখনো কোনো বন্ধুকে বলেনি। রদ্রকে সে যতদূর চেনে, সে নিশ্চিত, রন্দ্রও কাউকে কিছু বলেনি। রুদ্র-বিদিতার দূরে সরে যাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি ওদের বন্ধুরা। তারা ভেবেছিল এটি সাময়িক চিড়। কেউ কেউ মধ্যস্থতা করতে এসেছিল। বিদিতা রাজি হয়নি। নাক উঁচু বলে তাকে নিয়ে বন্ধু মহলে এক ধরনের গুঞ্জন আছে। সে বরাবরই একটু জেদি টাইপ। বিদিতা ভেবেছিল রন্দ্র নিজেই এসে অ্যাপলজি চাইবে। তাহলেই চুকেবুকে যাবে সব। তা হয়নি। রন্দ্র আসেনি আর। সেটি ছিল ফাইনাল ইয়ার। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ছিটকে গেল এদিক-সেদিক। বিচ্ছিন্ন হবার প্রথমদিকে বিদিতা কখনো সখনো কোনো না কোনো বন্ধুর মাধ্যমে রাদ্রর খোঁজখবর পেত।
অতঃপর ধীরে ধীরে কালের নিয়মে নিজ নিজ বলয়ে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল। জীবন বুঝি এ রকমই। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বৃত্তের বাইরে এসে কারও সন্ধান করা হয়ে ওঠে না আর। কিন্তু বিদিতার আলো-আঁধারের জাফরি কাটা 'অন্তরমহলে রদ্র একেবারে তাঁবু গেড়ে বসলো। বিদিতার জীবনের প্রথম পুরুষ স্পর্শের সেই স্মৃতি ফিকে তো হলোই না বরং প্রোজ্জ্বল হয়ে রইলো। মাঝের একযুগ তার দেখা পায়নি ঠিকই, কিন্তু স্মৃতিতে মিশে ছিল প্রমূর্ত প্রাখর্যে। আজ নিয়তির আশ্চর্য নির্বন্ধে সেই রদ্র তার সহযাত্রী। সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি তার পাশে তার গা ঘেঁষে বসে আছে। রুদ্র মুখে অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে বললো,
'এই যাঃ, তোর সঙ্গে তো আলাপ করিয়ে দেয়াই হয়নি।' বলেই পাশের ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললো, 'ইনি আমার মা।' তারপর বিদিতার দিকে তাকিয়ে হাসলো, 'আর এ বিদি। ইউনিভার্সিটিতে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।' বিদিতা দুহাত জড়ো করে হাসলো, 'আমার নাম বিদিতা কমল। ও দুষ্টুমি করে আমায় বিদি বলে ডাকতো।' 'ভারি মিষ্টি নাম তো।' ভদ্রমহিলা সালামের প্রত্যুত্তরের ভঙ্গি করে বললেন, 'কিন্তু আমার মেয়ে প্রেমার বিয়েতে তোমায় দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। এমন আলোর ফুলকির মতো মেয়েকে একবার দেখলে তো ভোলার কথা নয়। বেস্ট ফ্রেন্ড সেদিন অ্যাবসেন্ট ছিল বুঝি?' বিদিতা আড়চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে। তারপর ভদ্রমহিলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, 'আসলে তখন আমার এমন একটি জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল...।'
তারপর প্রসঙ্গ পালটে বললো, 'আপনারা কতোদূর যাচ্ছেন?' 'চিটাগং। রুদ্র একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করে। গত বছর ওর বাবা চলে যাবার পর ছেলে কিছুতেই আমায় একা থাকতে দিতে চায় না।' ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ বুজে আকাশপাতাল ভাবছে বিদিতা। যা কিছু আঁকড়ে ধরে সাধারণ কোনো মেয়ে সুখের সাগরে ভাসে, সবই তার রয়েছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্বামী, ফুটফুটে একটি সন্তান, সাজানো গোছানো বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি, কী নেই তার। ঘরে বন্দি নিঃসঙ্গ গৃহবধূও সে নয়। মেটা বেতনের ভালো একটি চাকরিও করে। তবুও ভালো না লাগার একটি জটিল আবর্তে ঢুকে বসে আছে
নিউজটি আপডেট করেছেন : Daily Sonali Rajshahi
কমেন্ট বক্স